হিন্দুশূণ্য বাংলাদেশ তত্ত্বের স্রষ্টা গ্রেপ্তারঃ
গত বৃহস্পতিবার রাতে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারকাতকে গ্রেপ্তার করেছে বর্তমান বাংলাদেশ সরকার। এননটেক্স গ্রুপের নামে ২৯৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে এই গ্রেপ্তার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল বারকাত বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ছিলেন। কিন্তু এ’হেন অর্থনীতিবিদকে গ্রেপ্তারের আসল কারণ কী! মূল কারণ ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয় বারকাত সাহেবের ‘বাংলাদেশে কৃষি ভূমি জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ নামের বইটি। বইটির একটি অনুচ্ছেদ হলো ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভূসম্পত্তিকেন্দ্রিক প্রান্তিকতা : শত্রু ও অর্পিত সম্পত্তি আইন’। এখানে ৭১ নম্বর পৃষ্ঠায় আবুল বারকাত লিখেছেন : ‘আমার হিসেবে প্রায় পাঁচ দশকে ১৯৬৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত আনুমানিক ১ কোটি ১৩ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ নিরুদ্দিষ্ট হয়েছেন। ’আবুল বারকাত সাহেবের এই গবেষণা বলে, দেশ থেকে প্রায় ১ কোটি ১৩ লক্ষ হিন্দু হারিয়ে গেছেন। ফলে হিন্দুদের সংখ্যা কমে আসছে। আবুল বারকাত সাহেব আরও বলেছিলেন, এরকম চললে ৫০ বছর পরে দেশে কোনো হিন্দুই থাকবে না। মনে রাখবেন সেটা ছিল শেখ হাসিনার আমল।
বাংলাদেশে হিন্দুবিদ্বেষ পাকনীতির অনুসারীঃ
২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করেন যেখানে ইতিহাসবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞরা বক্তা এবং সাংবাদিকদের মধ্যে গুটিকয়েক আমন্ত্রিত ছিলেন। অধ্যাপক আবুল বারকাত ছিলেন সেই অনুষ্ঠানের চেয়ারম্যান। আমার বক্তব্যের বিষয় ছিল ‘পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্তভাগ ও পরবর্তী ঘটনাবলী’। পাকিস্তান যে পরিকল্পনাহীন ও অপ্রত্যাশিতভাবে সৃষ্টি হয়েছিল এবং যার বীজ ছিল হিন্দু বিদ্বেষ, কথাটা আমি স্পষ্ট বলেহিলাম। পরবর্তীতে গণতন্ত্রের সূত্রপাতের বদলে সামরিক শাসন ও একনায়কতন্ত্রের ধাত্রীভূমি হয়ে ওঠে পাকিস্তান যার প্রভাব বাংলাদেশেও বিদ্যমান। শুধু তাই নয় স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দুরা চিরকালই নিপীড়িত ও তাদের সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো মোতাবেক, ১৯৫১ সালে এদেশে সংখ্যালঘুদের অনুপাত ছিল ২৩.১, যা ২০১১-তে এসে দাঁড়িয়েছে ৯.৬-এ। স্বাধীনতার আগে দেশভাগের প্রেক্ষাপটে হিন্দু-ধর্মাবলম্বী অনেকেই দেশত্যাগ করেছেন, সেটা ভিন্ন একটা প্রেক্ষাপট। ১৯৭১-এর পরেও, নানা ঘটনার প্রেক্ষিতে এদেশে হিন্দুদের উপর অত্যাচার হয়েছে। ফলে আনুপাতিক সংখ্যা কমেছে দ্রুত হারে।
প্রিয়া সাহার ক্ষোভ ও নতুন বাংলাদেশঃ
সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে যে চর্চা বাংলাদেশে শুরু হয়েছিল। ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই ওয়াশিংটনে ‘ধর্মীয় স্বাধীনতায় অগ্রগতি’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রিয়া সাহা। হোয়াইট হাউজে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা মৌলবাদীদের নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ‘নিখোঁজ’ হয়েছেন। ওই কথার ভিডিও প্রকাশ্যে আসার পর বাংলাদেশে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। তার দেওয়া পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, দেশে প্রতিবাদও হয়। প্রিয়া সাহার বক্তব্যকে ‘দেশদ্রোহী’ কাজ বলে কঠোর শাস্তি দাবি করেছিলেন অনেকেই। কিন্তু প্রিয়া সাহার ব্যাখ্যা না-শুনে কোনও আইনি ব্যবস্থা না-নেওয়ার জন্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। লেখিকা তসলিমা নাসরিন ফেসবুকে লেখেন, ‘ট্রাম্পকে প্রিয়া সাহা যা বলেছেন, কমই বলেছেন। খুব মাপা সময়। ভয়াবহতা বর্ণনা করার সময় তাই পাননি।’ কিন্তু ২০২৪ এর ৫ অগাস্ট যে তথাকথিত আন্দোলনের নামে শাসক বদল হল তারপরে সংখ্যালঘু নির্যাতনে খোলখুলি নেমে পড়েছে সে’দেশের দখলদার সরকার। ঘর জ্বালানো, হত্যা, আটক করে জেলে পোরা, ধর্ষণ – যা খুশি করার চিত্র পুরো বাংলাদেশ জুড়ে। মন্দির পাহারার কূনাট্য কিছুদিন প্রচারিত হলেও মন্দির-মাজার ধ্বংসের চিত্র আজ বিশ্বের কাছে ফুটে উঠেছে। সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের ঘটনাগুলিকে শুধুমাত্র ‘রাজনৈতিক কারণে’ ঘটেছে বা ‘সংবাদমাধ্যমের অতিশয়োক্তি’ বলে চালানোর চেষ্টা করেছে ইউনুস সরকার। গত বছরের ৫ অগস্ট থেকে চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে মোট ২৩৭৪টি অভিযোগ উঠেছে। ইতিমধ্যে সে’সংখ্যা ৫০০০ ছাড়িয়েছে।
অধ্যাপক আবুল বারকাতের মুক্তি চাইঃ
এগুলি সবই একনায়কের ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার প্রচেষ্টার অঙ্গমাত্র। তাতে নতুন সংযোজন অধ্যাপক আবুল বারকাতকে গ্রেপ্তার করা। যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্য সব দেশেই বাংলাদেশের এই ধর্মীয় সহিংসতার নিন্দা করা হয়েছে। বাংলাদেশের কিছু গর্দভসদৃশ নাগরিক আছেন যারা হিন্দু নির্যাতন নিয়ে প্রসঙ্গ তুললে ভারতের মুসলমানদের ওপরে অত্যাচার হয় বলে ফেক ভিডিও ছেড়ে দেন। কিন্তু তাদের মস্তিস্ক যে পুরীষ দ্বারা গঠিত বোঝা যায় কেননা ভারতে রাস্ট্রক্ষমতায় টিঁকে থাকতে গেলে মুসলমানদের সমর্থণ জরুরী। মুসলমানরা যে ভারতে অন্যান্য ধর্মের নাগরিকদের সাথে একাসনে বসবাস করেন তা সর্বক্ষেত্রে প্রমানিত। দেখুন, অধ্যাপক আবুল বারকাত অর্থনীতির বিদগ্ধ অধ্যাপক এবং তাকে গ্রেপ্তার যে তার স্পষ্ট ও সত্যভাষনকে চেপে দেওয়ার ইউনুসীয় কুবুদ্ধি তা যে কেউ বুঝবেন। এখন প্রত্যাশা এই যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি মুক্তি পান। বঙ্গীয় হিন্দুদের এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলা প্রয়োজন। বিশেষত তথাকথিত সেক্যুদের, পাশের বাড়িতে আগুন লাগলে তার আঁচ আপনার গায়েও লাগে। সেই আঁচে কি আপনি তাত্ত্বিক আলোচনা করবেন না আগুন নেভাবেন? সিদ্ধান্ত আপনাদের।
Post a Comment