প্রথম দেখাতেই প্রেম

প্রথম দেখাতেই প্রেম
"প্রথম দেখাতেই প্রেম"- এই বাক্যটি বরাবরই আমার কাছে অবিশ্বাস্য ছিল। এভাবে হুট করে কি প্রেম হয়? দেখা হবে, পরিচয় হবে, একে অপরকে জানা হবে, তবেই না অনুভূতি সৃষ্টি হবে। অন্তুত আমার যুক্তিতে এটাই বলে। কিন্তু এই সব যুক্তি, তর্ক, অবিশ্বাস ছাপিয়ে, এই ভয়ংকর ব্যাপারটা যে আমার সাথেই ঘটে যাবে, তা কি আমি কখনও কল্পনাও করেছিলাম?

তখন কেবল আমি এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। পরীক্ষা শেষ হওয়াতে বড় আপার বাড়িতে ঘুরতে গিয়েছিলাম। বড় আপার বিরাট বড় সংসার। শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, ভাসুর, দেবর, ননদ দিয়ে যেন সারাবাড়ি সবসময় মেতে থাকে। আর আমি বরাবরই চুপচাপ, শান্ত। স্বভাবগত কারণেই এত চিৎকার চেঁচামেচি বরাবরই অপছন্দ। এসবের জন্যই হয়তো দুদিনের বেশি ওবাড়িতে টিকে থাকতে পারলাম না। তাই কেউ নিতে না আসলেও একা একাই বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছিলাম।

একবুক সাহস নিয়ে বিকেল পাঁচটার ট্রেনে রওনা দিলাম। যেতে এক ঘন্টা লাগার কথা। অর্থাৎ সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে যাব। সিটও পেয়েছি জানালার ধারে। সব বেশ অনুকূলেই যাচ্ছিল। কিন্তু পাশের সিটেই বসেছেন এক অতি অভদ্র, বখাটেই বলা চলে। শুরু থেকেই কেমন একটা অন্যরকম ছোঁয়াছুঁয়ির চেষ্টা। আমি ভয় পেয়ে আড়ষ্ট হয়ে বসে শুধু একমনে আল্লাহকে ডাকছিলাম। তখনই একটা ভারী গলার আওয়াজ ভরসা হয়ে ভেসে আসল।

"এইযে ভাই, সিটটা তো আমার। তাই অসভ্যতা না করে উঠে যান।"

তার কথা শুনে হকচকিয়ে যায় বখাটে ছেলেটা। কোনো কিছু না বলেই বিব্রত ভঙ্গিতে উঠে চলে যায়। সে চলে যাওয়ার পর সেই গমগমে কণ্ঠস্বর অধিকারী ব্যক্তিটি সিটে বসলেন। এক নজর তার দিকে তাকিয়ে বাইরে দৃষ্টি দিলাম। কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারলাম, ওই একবারই তার দিকে নজর দেওয়ার সাথে সাথে নিজের মনটাও আমি স্বযত্নে তাকে দিয়ে দিলাম। আমার কিশোরী বয়সের আবেগ, অতি যত্নে লুকিয়ে রাখা অনুভূতি, গোপন কুঠুরিতে বন্দী ভালোবাসাটুকু একদম সোজা তার নামে লিখে দিলাম। বাইরের দিকে তাকিয়েই চোখ বন্ধ করে হৃদয়ের ধুকপুকুনি আওয়াজটুকুও যেন শুনতে পাচ্ছিলাম। আমার হঠাৎ মাথা ঘোরাতে থাকল, গলা শুকিয়ে যেতে থাকল। আচ্ছা, প্রথম দেখাতেও কী এতটা ভেঙে যাওয়া সম্ভব!

সেদিন পুরো রাস্তাটুকুই একরাশ মুগ্ধতার সাথে কেটে গেল। তার কথা বলার ধরণ, তাকানোর ধরণ, চলাফেরার ধরণ সবই যেন আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল। তার বসার স্টাইল, দাঁড়ানোর স্টাইল, পানি খাওয়ার স্টাইল কোনোকিছুই বাদ যায়নি। সবটাই গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। বাইরে ঝুম বৃষ্টি আর ট্রেনের ভিতরে আমার মনের ভিতর অনুভূতির তুমুল বর্ষণ, দুটোই যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল।সব মিলিয়ে আমি যেন চুপ হয়ে গেছিলাম। সদা হাস্বোজ্জ্বল মেয়ের চঞ্চল চাহনী যেন শান্ত হয়ে এসেছিল!

কিন্তু এটাতো আর অনন্তকালের ভ্রমণ না। ট্রেনও একসময় তার গন্তব্যে ঠিকই পৌঁছে যায়। আমিও তেমন ট্রেনের সাথে সাথে নিজের গন্তব্যে পৌঁছেছিলাম। কিন্তু ততক্ষণে আঁধার নেমে এসেছে। আর বাইরে তুমুল বৃষ্টি। নিজে একা বাড়ি যাব, এটা তো খুব করে বলে এসেছি। তাই কেউ নিতেও আসেনি। কিন্তু এদিকে এই সন্ধ্যায় একা একা বাড়ি যেতে ভয়ও লাগছে। আমি যে বরাবরই বাবা-ভাইয়ের হাত ধরে চলা মেয়ে। বাইরের কঠিন পৃথিবীতে তখনও আমার একা চলা শুরু হয়নি।

তবুও সব ভয় কাটিয়ে, একবুক সাহস জোগাড় করে যখনই সামনে আগাতে যাব, তখনই আবার সেই গমগমে কণ্ঠস্বর!

"কোনো সমস্যা হয়েছে কি?"

পেছনে তাকিয়ে দেখি সেই অচেনা ভদ্রলোক। যার নামে আমি ঠিক একটু আগেই নিজেকে লিখে দিয়েছি। আমার অপরিণত বয়সের আবেগ যার নামে করে দিয়েছি। কিন্তু তাকে কীভাবে উত্তর দিব! তাকে কি বলব যে, আমি ভয় পাচ্ছি, আমাকে প্লিজ একটু বাসায় দিয়ে আসেন! উঁহু, কী লজ্জাজনক বিষয়!

"আপনি কি ভয় পাচ্ছেন? বাসায় একা যেতে পারবেন না?"

একটু চোখ-মুখ কুঁচকে তিনি প্রশ্নগুলি করলেন। যেন কি এক অদ্ভুত প্রাণি সামনে দেখেছে। তার নজরের ধরণ দেখে, আমি লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেললাম। তারপর আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকে উত্তর দিলাম,

"আসলে এটাই আমার প্রথম একা করা জার্নি। তাই একটুউউ..."

তিনি আমার কথা পুরোপুরি শেষ করতে না দিয়ে বললেন,

"আচ্ছা, এখানে একটু দাঁড়ান। কোথাও যাবেন না কিন্তু!"

আমিও তার কথামতো দাঁড়ালাম। একদম সন্ধ্যা হওয়াতে একটু লোকজন কম আশেপাশে। আবার মানুষটা আমার সম্পূর্ণ অপরিচিত। তার কথাতে তাই অপেক্ষা করা ঠিক হচ্ছে কীনা এটাও বুঝতে পারছি না। দিনকালও তো খারাপ। তাই অনেকগুলো চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু সদ্য জন্ম নেওয়া অনুভূতির কাছে সেগুলো ঠিক শক্তভাবে দাঁড়াতেও পারছিল না।

কারও উপর অনুভূতি জন্মানোর প্রথম ধাপ হচ্ছে বিশ্বাস। কিন্তু এই স্বল্প পরিচয়ে কারও প্রতি বিশ্বাস জন্মানোউ কি সম্ভব? নাকি ওইযে ট্রেনে একা বসে থাকা মেয়েটাকে একটা বখাটের ছোঁয়াছুঁয়ি থেকে বাঁচালো, তাকে একটু ভরসা দিল, এতেই কি তার প্রতি বিশ্বাসটা জন্মে গেছিল আমার? আমি আসলে কিছুই জানি না। আমি শুধু জানি, সেই মুহূর্তে আমার পরিবারের বাইরে আমি যদি একজন মানুষকেউ চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে থাকি, ভরসা করে থাকি, তবে সেই মানুষটা তিনি! কিন্তু এই অগাধ বিশ্বাস আর ভরসার কারণ আমার অজানা।
"রিকশায় উঠে আসুন।"

হঠাৎ একটা রিকশা এসে আমার ভাবনায় ছেদ ঘটাল। সাথে মানুষটার বলা এই বাক্য। আমি কিছু বলতে নিতেই তিনি আবার বলে উঠলেন,

"কুয়াশার মোড়ের তিন নম্বর বাসা, তাইতো?"

ব্যস, এতটুকুই যথেষ্ট। যতটুকু শঙ্কা ছিল সব কাটিয়ে রিকশায় উঠে গেলাম। হয়তো তার উপর কোনো অজানা ভরসার কারণেই পেরেছিলাম এটা করতে। কিন্তু পরপর এতকিছু হওয়াতে, সে কীভাবে আমার বাসার ঠিকানা জানল কিংবা তার পরিচয় কী, কোথায় যাবে, এসব কিছুই জানার কথা আর মাথায় এলো না। তার সাথে আবার ঠিক কথা হলো আমার বাসার মোড়ের সামনে এসে। মোড়ের কাছে আসতেই যখন নেমে যাচ্ছিলাম, তখন তিনি বললেন,

"শোনো এরকম অন্যকেউ বললে হুটহাট রিকশায় উঠে যাবে না। আর একা একা কোথাও যাবে না বুঝেছো?"

একরাশ মন খারাপ নিয়ে আমি তাকে মাথা নেড়ে বোঝালাম বুঝেছি। সে কী ভাবলো আমাকে! আমি সবার কথাতেই রিকশায় উঠে যায় নাকি! আমি তো কাউকেই বিশ্বাস করি না। দিনকাল খারাপ আমিও জানি। কিন্তু কেন যেন তাকে বিশ্বাস করতে মন চেয়েছিল আমার! ভরসা করতে মন চেয়েছিল। আর সে এটা বুঝলো না!

অভিমান নিয়ে মাথা নিচু করে আমি বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলাম। তখনই দেখি, পিছনে রিকশা থেকে নেমে সে এগিয়ে এসেছে। হঠাৎ আমার চোখের সাথে চোখ মিলিয়ে, মাথাটা একটু এগিয়ে ফিসফিসিয়ে তিনি বলে উঠলেন,

"শোনো মেয়ে, চঞ্চল চোখের মেয়েদের মোটেও শান্ত দৃষ্টিতে মানায় না। একদম বিচ্ছিরি লাগে। আর ময়না পাখির নামে যার নাম, তাকে তো এত বেশি চুপচাপ থাকা আরও মানায় না।"

আমি চমকে উঠলাম। তিনি আমার নাম জানেন! কীভাবে জানেন! কে তিনি! কীভাবে চিনেন আমাকে! কিন্তু কোনো কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তিনি রিকশায় উঠে চলে গেলেন। অদূরে মিলিয়ে গেলেন। আর আমি একমনে ওদিকে তাকিয়ে রইলাম। তখনও যদি জানতাম, তার সাথে এই স্বল্পক্ষণের আলাপ আমার মনে কী বিশাল প্রতিক্রিয়া ফেলবে! কী বিশাল পরিমাণের ভালোবাসার জন্ম দিবে! তাহলে হয়তো তাকে যেতে দিতাম না। ধরে বেঁধে তাকে রেখে দিতাম! কিংবা তাকে খুঁজে পাওয়ার পথ জেনে নিতাম!

সোর্স: YTS STORY

Post a Comment

Featured Post

পাখিটা বন্দী আছে সোনার খাঁচায়!

পাখিটা বন্দী আছে সোনার খাঁচায়! দূর বিদেশে বাণিজ্যে গিয়ে এক বণিক সেখানকার এক বনে বিশেষ একটি পাখির গান শুনে মুগ্ধ হলেন এবং পাখিট...

জনপ্রিয়

[blogger]

MKRdezign

Mohammod Sahidul Islam

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget