Dr Mozahedul Hoque Repon এর ওয়াল থেকে নেওয়া।
---------------‐--------------------------------------------------------
২১ পাতার চুক্তির কপিটি মোটা দাগে ৬ ভাগে বিভক্ত। অর্থাৎ ৬ ধরনের শতাধিক শর্ত সংক্রান্ত আলোচনা রয়েছে চুক্তিতে। এগুলো হলো—কর সংক্রান্ত শর্ত, অশুল্ক বাধা সংক্রান্ত শর্ত, ডিজিটাল বাণিজ্য ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত শর্ত, রুলস অব অরিজিন সংক্রান্ত শর্ত, অর্থনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত শর্ত এবং বাণিজ্যিক শর্ত।
অর্থনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত শর্ত এবং বাণিজ্যিক শর্তগুলো পর্যালোচনা করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ ও চাপের বিষয়টি স্পষ্ট বোঝা যায়। এসব শর্তের মাধ্যমে বাংলাদেশে মার্কিন পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধি যেমন নিশ্চিত করা হয়েছে। তেমনি চীনা আমদানি কমাতেও এতে স্পষ্ট নির্দেশনা আছে।
অশুল্ক বাধা সংক্রান্ত শর্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, মার্কিন বিভিন্ন মানসনদ বাংলাদেশকে বিনাপ্রশ্নে মেনে নিতে বলা হয়েছে। আর যেসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো আইন প্রণয়ন কিংবা স্ট্যান্ডার্ড স্থাপন করতে পারেনি, সেসব ক্ষেত্রে মার্কিন স্ট্যান্ডার্ড প্রতিস্থাপন করতে বলা হয়েছে। যাতে মার্কিন পণ্য অবাধে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে।
বাণিজ্যিক শর্ত (৬টি)
১. মার্কিন সামরিক ইকুইপমেন্ট আমদানি বাড়াতে হবে বাংলাদেশকে এবং চীনা সামরিক পণ্য আমদানি কমাতে হবে।
২. রাষ্ট্রীয় আকাশ পরিবহন সংস্থা বিমানের মাধ্যমে মার্কিন বেসামরিক উড়োজাহাজ ও যন্ত্রাংশ আমদানি বাড়াতে হবে।
৩. মার্কিন জ্বালানি আমদানি বৃদ্ধি নিশ্চিত করত হবে বাংলাদেশকে। এবং তরল প্রাকৃতিক গ্যাস এলএনজি আমদানিতে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করতে হবে।
৪. সামাজিক নিরাপত্তা খাতের জন্য মার্কিন গম আমদানি বাড়াতে হবে।
৫. সামরিক বাহিনী ও সরকারি সংস্থার জন্য মার্কিন সয়াবিন তেল আমদানি বাড়াতে হবে। এবং সয়াবিন সংরক্ষণের জন্য মার্কিন কোম্পানির অংশীদারিত্বে অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে।
৬.মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই চুক্তি স্বাক্ষর করে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকে জানাতে হবে।
অর্থনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত শর্ত (৬টি)
১. জাহাজ নির্মাণ শিল্প ও শিপিং খাতের বিকাশে যুক্তরাষ্ট্রের সমমানের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
২. বন্দর, জেটি ও জাহাজে চীনের তৈরি লজিস্টিকস সিস্টেম লগিঙ্ক (LOGINK) ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে। এই ব্যবস্থাটি এরই মধ্যে নিরাপত্তা অজুহাতে নিষিদ্ধ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
৩. ব্যুরো অব ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড সিকিউরিটির অনুমতি ছাড়া কোনো ধরনের মার্কিন পণ্য দেশটিতে রপ্তানি, পুনঃরপ্তানি করা যাবে না। এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৪. ইউএস উৎপাদিত ও নিয়ন্ত্রিত পণ্যের আমদানি সংক্রান্ত সকল কাস্টমস তথ্য দেশটিকে দিতে হবে।
যাতে মার্কিন সংস্থাগুলো লেনদেন চিহ্নিত করতে পারে।
৫. বাংলাদেশকে রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। যেখানে আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে সিভিল ও ক্রিমিনাল ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকবে। এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অংশীদার করতে হবে।
৬ বিভিন্ন দেশের জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত এমন ধরনের সফটওয়্যার তৈরিতে স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে।
ডিজিটাল বাণিজ্য ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত শর্ত (৫টি)
১. তথ্য আদান প্রদানে বৈশ্বিক ক্রস-বর্ডার গোপনীয় নীতিমালা সিবিপিআর এবং পিআরপি স্বীকৃতি দিতে হবে বাংলাদেশকে।
২. ব্যক্তিগত ডেটা গোপনীয়তা নীতিমালা প্রণয়নে মার্কিন সরকার ও দেশটির বেসরকারি খাতের সঙ্গে আলোচনা বাড়াতে হবে। এবং ফিডব্যাকের প্রতিফলন থাকতে হবে।
৩. সাইবার সিকিউরিটি অধ্যাদেশ ২০২৫—এ মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতে পর্যাপ্ত সেফগার্ড নিতে হবে। সাইবার অপরাধের কঠোরতর সাজা নিশ্চিত করতে হবে।
৪. ২০২১ সালের ওটিটি নীতিমালা সংশোধন অথবা বাতিল করতে হবে। যাতে এন্ড টু এন্ড এনক্রিপ্টেড সেবায় শনাক্তকরণ শর্ত না থাকে।
৫. ৬০০ থেকে ৭০০ মেগাহার্টসের স্পেকট্রাম এলপিআই ও ভিএলপিদের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে।
কর সংক্রান্ত শর্ত মার্কিন পণ্য রপ্তানিতে ৩ ধরনের শুল্ক কমাতে বলেছে দেশটি। এগুলো হলো কাস্টমস ডিউটি, সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি এবং রেগুলেটরি ডিউটি।
১৩ খাতে নন ট্যারিফ বাধা সংক্রান্ত শর্তঃ
ওষুধ, কৃষি, পরিবেশসহ ১৩ খাতে নন ট্যারিফ ব্যারিয়ার বা অশুল্ক বাধা চিহ্নিত করে এবং কার্যকর ব্যবস্থা নিতে প্রায় অর্ধশত শর্ত দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
মেডিকেল ডিভাইসেসঃ
চিকিৎসা ব্যবস্থায় ব্যবহৃত মার্কিন প্রযুক্তি পণ্য আমদানিতে বেশকিছু বাধা চিহ্নিত করেছে দেশটি। এসব বাধা দূর করতে ৪টি শর্ত দেওয়া হয়েছে। এসব শর্তে মূলত মার্কিন নিয়ন্ত্রক সংস্থা এফডিএ’র সনদ বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশকে মেডিকেল ডিভাইস রেগুলেটরি আন্তর্জাতিক ফোরাম-আইএমডিআরএফ এর সদস্য হতে বলা হয়েছে।
ফার্মাসিউটিক্যালসঃ
বাংলাদেশের ওষুধ খাতেও বড় নজর দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন ওষুধের বাজার বিস্তৃত করতে এফডিএ’র সনদ বিনাপ্রশ্নে মেনে নেওয়ার শর্ত দিয়েছে ইউএসটিআর। মার্কিন টেরিটরির ভেতরে উৎপাদিত কিংবা এফডিএ অনুমোদিত যে কোনো উৎপাদন কেন্দ্রে তদারকি করতে পারবে না বাংলাদেশ।
মোটর গাড়ি ও যন্ত্রাংশঃ
মার্কিন গাড়ির প্রবেশাধিকার নিশ্চিতে সব ধরনের বৈষমমূলক ব্যবস্থা তুলে নিতে হবে বাংলাদেশকে। প্রবেশাধিকার দিতে হবে মার্কিন মোটর ভেহিকেল নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান এফএমভিএসএস এর আওতায় উৎপাদিত যে কোনো অটোমেটিভ পণ্য। অর্থাৎ মার্কিন গাড়ি ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে বাড়তি কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও শর্ত আরোপ করা যাবে না।
পুনঃউৎপাদিত পণ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুনঃউৎপাদিত পণ্য বাংলাদেশের বাজারে ছাড়তে বাড়তি কোনো লাইসেন্সিং বা পরীক্ষার শর্ত দেওয়া যাবে না।
কৃষিঃ
কৃষিখাতের অশুল্ক বাধা দূর করতে কড়া অবস্থানে মার্কিং যুক্তরাষ্ট্র। কৃষির বিভিন্ন উপখাতে বেশকিছু শর্ত বাস্তুবায়ন করতে বলেছে দেশটি। এসব উপখাতে মার্কিন বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার সনদ মেনে নেওয়ার পাশাপাশি তাদের শর্তের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতি উন্নয়নের কথাও বলা হয়েছে। যেমন ডেইরি খাতে নিরাপত্তায় কমপক্ষে মার্কিন স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলার শর্ত দেওয়া হয়েছে। মার্কিন সংস্থাগুলোর দেওয়া হালাল সনদও মেনে নিতে শর্ত দেওয়া হয়েছে।
আমদানি সনদ সংক্রান্তঃ
আমদানি সনদ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশে যেসব শর্ত পূরণ করতে হয় তা দ্রুত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকে জানাতে হবে। মার্কিন খাবার ও কৃষিপণ্য আমদানিতে অনুমতি পত্র চাইতে পারবে না বাংলাদেশ।
মেধাস্বত্ব সংক্রান্ত শর্তঃ
মেধাস্বত্ব মার্কিন শুল্ক আলোচনার উল্লেখযোগ্য দিক। দীর্ঘদিন ধরে দেশটি মেধাস্বত্ব আইন বাস্তবায়নে চাপ দিয়ে আসছে। দেশটির অভিযোগ আইপিআর না মেনে বাংলাদেশ নানা ধরনের নকল পণ্য উৎপাদন করছে। মেধাস্বত্ব সংক্রান্ত ১৩টি আন্তর্জাতিক চুক্তি ও কনভেশনে যুক্ত হতে বাংলাদেশকে শর্ত দিয়েছে দেশটি। এগুলোর মধ্যে আছে ব্রাসেলস কনভেনশন, মাদ্রিদ প্রটোকল, সিঙ্গাপুর চুক্তি, প্যাটেন্ট আইন চুক্তি, মারাকেশ চুক্তি, হেগ এগ্রিমেন্ট, বুদাপেস্ট এগ্রিমেন্ট ইত্যাদি।
সেবাখাত ও বিনিয়োগ সংক্রান্তঃ
সেবাখাতের কোম্পানিগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক রিইন্সুরেন্সের বিধান বাতিল করতে বলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সার্ভিস ডামেস্টিক রেগুলেশনে যুক্ত হতে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে বাংলাদেশকে।
অনতি বিলম্বে মার্কিন ফার্মগুলোর সকল পাওনা পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে। পাশাপাশি মুনাফা প্রত্যাবাসনে কোনো বাধা রাখা যাবে না। তেল, গ্যাস, ইনস্যুরেন্স ও টেলিকম খাতে মার্কিন কোম্পানির অংশগ্রহণ বাড়াতে মালিকানা সংক্রান্ত বাধা দূর করতে হবে। মার্কিন ব্যবসায়ীদের চাহিদামতো নো অবজেকশন সার্টিফিকেট-এনওসি দিতে হবে।
শ্রম সংক্রান্ত শর্তঃ
বাংলাদেশের শ্রম অধিকার নিশ্চিতে আইন সংশোধনসহ বেশকিছু বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইউএসটিআরের দেওয়া চিঠিতে এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কিছু শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, কারখানায় শ্রমিক সংগঠন করতে সম্মতিদাতা শ্রমিকের সংখ্যা ২০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। ইপিজেডের শ্রমিকদের সংগঠন করার পূর্ণ অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ন্যায্য দাবি আদায়ে জড়িত গার্মেন্টস শ্রমিক ও নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সকল মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
পরিবেশ সংক্রান্ত শর্তঃ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট বলেছে, আইন যেন পরিবেশের সুরক্ষা করে এটা বাংলাদেশকে নিশ্চিত করতে হবে। কার্যকরভাবে আইনের প্রয়োগ করতে বলেছে দেশটি। নানা ধরনের অবৈধ ব্যবসা বন্ধে সহযোগিতা বাড়াতেও শর্ত দিয়েছে ইউএসটিআর। বণ্যপ্রাণি পাচার রোধ, সমুদ্রে অনিয়ন্ত্রিত মাছ ও প্রাণি শিকার রোধেও নানা শর্ত দেওয়া হয়েছে।
Post a Comment