উদ্দেশ্যসফল জুলাই ‘বিপ্লব’


উদ্দেশ্যসফল জুলাই ‘বিপ্লব’, ব্যর্থ কে বলে? 
অমিত গোস্বামী   

উদ্দেশ্য – ১

বাংলাদেশের জুলাই আন্দোলনের ভরসাপূর্তি বা বর্ষপূর্তিতে বাংলাদেশের সংবাদপত্রের যে শিরোনাম উঠে আসছে তা হল - শেষ পর্যন্ত জুলাই অভ্যুত্থান কি ব্যর্থ? এখন সবাই ‘অভ্যুত্থান’ বলছেন, ‘বিপ্লব’ নয়। জুলাই আন্দোলনের উদ্দেশ্য কী ছিল? শাসক বিদায়। কাজেই প্রথম উদ্দেশ্য সফল। 

উদ্দেশ্য – ২

ভারতবিরোধিতা ও হিন্দু বিরোধিতা বাংলাদেশের চিরকালীন রাজনৈতিক পুঁজি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের দখলদার প্রধান সেই হাওয়াতে চিকেন নেক, উত্তর পূর্ব রাজ্য, ২৬ লক্ষ ভারতীয়র বাংলাদেশে চাকরি করার গপ্পো দিয়ে উসকে দিতে পেরেছেন। চিন্ময় স্বামীকে জেলে রাখা, আওয়ামী সংযোগের অভিযোগে হিন্দুদের ঘর পোড়ানো, নরসুন্দর বাপ-বেটাকে ইসলাম অবমাননার দায়ে মেরে জেলে পাঠানো, হিন্দু নারী ধর্ষণ সবই এই বিরোধিতার ফসল। কাজেই দ্বিতীয় উদ্দেশ্য সফল। 

উদ্দেশ্য – ৩

মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, একাত্তর পাকিস্তানের সবচেয়ে অস্বস্তিকর জায়গা ছিল। নতুন শাসকদেরও তাই। বঙ্গবন্ধুর মুর্তির মাথায় প্রস্রাব করে মুক্তিযুদ্ধ ও একাত্তরকে মুছে ফেলার সূত্রপাত। ৩২ নং ধানমন্ডি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ধ্বংস করে ইতিহাস মোছার বাধাহীন সাফল্য অবশ্যই এই জুলাই বিপ্লবের তৃতীয় উদ্দেশ্যসফল কীর্তি। 

উদ্দেশ্য – ৪

চতুর্থ উদ্দেশ্য সত্যিই মহান। ভারতের সাথে বানিজ্য ঘাটতি মেটানো। ভারত থেকে বাংলাদেশে যেত ৯০০ কোটি ডলারের পণ্য যার বেশিটাই ছিল তুলো, সুতো ও পোশাক শিল্পের যন্ত্রাংশ। বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসত ১৫৭ কোটি ডলারের পণ্য যার মধ্যে পোশাক, পাট ও প্লাস্টিকজাত পণ্য মুখ্য ছিল। যে তুলো, সুতো বা যন্ত্রাংশ যেত তার পরিমাণ ৬৫০ কোটি ডলার। সেগুলি পোশাক হয়ে ফিরত ভারতে ও ভারতের দেওয়া ফ্রি ট্রান্সশিপমেন্টে যেত ইউরোপ ও আমেরিকায়। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার ৮০ শতাংশ পূর্ণ হত পোশাক ব্যবসা থেকে। জুলাই আন্দোলনের বাজিগর ভারত থেকে তুলো, সুতো বা যন্ত্রাংশ আমদানি বন্ধ করেছে। বেশ করেছে। নিজেদের উৎপাদনের ক্ষমতা নেই বলে আমদানি করছে চিন থেকে ২৪% বেশি মূল্যে। এদিকে ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট, স্থল বন্দর ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে। বেশিরভাগ ব্যবসাও বন্ধ। কিন্তু বানিজ্য ঘাটতি তো মিটেছে। 

উদ্দেশ্য – ৫

শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল তৈরি করে সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের যে উন্নয়ণমুখী ভাবমুর্তি তৈরি করেছিলেন, এটা ঠিকই। কিন্তু বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতা ছিল না। শাসনযন্ত্রের দমনপীড়ন ছিল। পাকিস্তান সংস্কৃতিতে বহু আগে সৃষ্ট অনুশাসনহীনতা, আইন-শৃঙ্খলা অমান্য করা, নারী নিপীড়ন, ধর্মীয় ভুল ব্যাখ্যার উত্তরাধিকার বাংলাদেশের কিছু মানুষ বহন করছিল। বহন করছিল দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার বীজ। ফলে বিদেশি শক্তির অর্থায়নে ও বুদ্ধিতে শেখ হাসিনা উৎখাতের উদ্দেশ্যর সার্থক রূপায়ন ঘটাতে সক্ষম হল। 

উদ্দেশ্য – ৬

পূর্বতন শাসককে ‘ফ্যাসিস্ট’ বলেও নির্বাচন পরীক্ষায় পাস করে নয়, বরং মৌলবাদী শক্তির সাহায্যে যতদিন সম্ভব ক্ষমতা কুক্ষিগত রকরে রাখাও এই আন্দোলনের একটি অপ্রকাশ্য উদ্দেশ্য ছিল। সেই উদ্দেশ্যসাধনে সম্পূর্ণ সফল জুলাই আন্দোলন। 

উদ্দেশ্য – ৭

নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’র হজমিগুলি খাওয়ানো জুলাই আন্দোলনের নেতাকূলের উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতার চিটেগুড় খেয়ে স্থুলতাপ্রাপ্তি। বাস্তববোধশূন্য কিছু ছাত্রনেতা ও তাদের পরিবার আজ দু’হাতে দেশকে লুটছে। কাজেই আন্দোলনের এই উদ্দেশ্যও সফল। যখন বিভিন্ন অঙ্গবিহীন জুলাই যোদ্ধাদের ছবি সোশাল মিডিয়াতে ভেসে আসে, তখন জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করে এই মৌলবাদী অনুশাসনহীন অর্থনৈতিক নিম্নগামিতা দেখার জন্যে আপনারা রাজপথে নেমেছিলেন? উন্নত চিকিৎসা অবধি পান নি। সাহায্য ও ভাতার ঘোষনা শুনেছেন, কিন্তু হাতে পান নি। তাহলে আপনাদের দেশপ্রেম কোন পদ্মার জলে লাট খাচ্ছে? 

ভারতের প্রাপ্তিঃ 

জুলাই আন্দোলনের উদ্দেশ্যসফলতার কথা বললাম। এবার একটা ঘটনা বলি। ২০১৮ সালের মে মাসে, ভারত সফর থেকে ফিরে যাওয়ার পরে পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার পত্রিকা শিরোনাম করেছিলো, "বাংলাদেশ ভারতের কাছে প্রতিদান চায়"। কেন? কারণ সেই সফরে তিস্তা চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ চাপ দিয়েছিল। সেই সূত্র ধরে সাংবাদিক মনজুরুল আহাসান বুলবুল শেখ হাসিনার কাছে আনন্দবাজারের শিরোনামের সত্যতা জানতে চান। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা ভারতকে যা দিয়েছি তা ভারত সারা জীবন মনে রাখবে। প্রতিদিনের বোমাবাজি গুলি থেকে আমরা তাদের শান্তি ফিরিয়ে দিয়েছি। এটা তাদের মনে রাখতে হবে।‘ বাংলাদেশ সংবাদ মাধ্যম ‘আমরা ভারতকে যা দিয়েছি তা ভারত সারা জীবন মনে রাখবে।‘ এটাকে শিরোনাম করে বাংলাদেশ মিডিয়া ধোঁয়াশা ছড়ালো। কিন্তু পরের কথাটা অর্থাৎ শেখ হাসিনার সন্ত্রাসবাদের প্রতি জিরো টলারেন্স যে ভারতের উত্তর পূর্ব রাজ্যে শান্তি ফিরিয়েছিল, তার উল্লেখ বিশেষ ছিল না। কথাটা একশভাগ সত্যি ও গত দশ বছরে এটাই ভারতের প্রাপ্তি বাংলাদেশের কাছ থেকে। 

ভারতের পদক্ষেপঃ 

এর বাইরে বাংলাদেশ থেকে ভারতের প্রাপ্তি শূণ্য। ফ্রি করিডোর, রেল সংযোগ কিছুই পায় নি। তাই ভারত এখন আগের মত নমনীয় অবস্থানে নেই। ফ্রি ট্রান্সশিপমেন্ট, ৭০ টি স্থল বন্দরে অবাধ পণ্য পারাপারের সুবিধা, বিনা পয়সায় ভারতের ওপর দিয়ে গ্রিডের মাধ্যমে নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি, সস্তায় ডিজেল ভারতের থেকে নেওয়া যা দিয়ে বাংলাদেশের ১১৭ টি ইউনিটে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়, সব কিছুই বাংলাদেশের প্রাপ্ত সুবিধা ছিল যার বেশ কিছু ভারত তুলে নিয়েছে। বাকিগুলি তোলা সময়ের অপেক্ষা। ক্রমাগত ‘পুশ ইন’ বা সীমান্তে ভারতীয় অঞ্চলে প্রবেশ করলে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী গুলি চালাচ্ছে আত্মরক্ষার দোহাই দিয়ে। আগামী ২০২৬ এ গঙ্গা নদী চুক্তি। সেখানেও ভারত যে তাদের শর্তে নদীচুক্তি করবে তাও জানিয়ে দিয়েছে। এগুলি জুলাই আন্দোলনের ফলশ্রুতি। দেশ মানে কী? শাসক বিদায়? নাকি সর্বাঙ্গীন উন্নয়ণ? এই জুলাই আন্দোলন বাংলাদেশে সর্বক্ষেত্রে যে বিভাজনের জন্ম দিয়েছে সেই রাস্তা থেকে ফিরতে অনেক সময় লাগবে। 

এ কেবল দিবা রাত্রে… 

বাংলাদেশ যে পিছাচ্ছে তা আজ অন্ধ সরকার সমর্থক ছাড়া সবাই বুঝতে পারছেন। জুলাই আন্দোলনে রাস্ট্রের নির্দেশে যেদিন থেকে গুলি চলেছিল সেদিনই সেটা আন্তর্জাতিক ইস্যু হয়ে উঠেছিল। আন্তর্জাতিক জনমত গঠনের প্রস্তাব এসেছিল। ভারতীয় জনসমাজ তার তীব্র নিন্দা করেছিল। আজ আজ? বাংলাদেশ নিয়ে বললেই সম্মিলিত হুক্কাধ্বনি শোনা যায়। মনে হয় - এ কেবল দিনে রাত্রে জল ঢেলে ফুটা পাত্রে বৃথা চেষ্টা তৃষ্ণা মিটাবারে।

Post a Comment

Featured Post

পাখিটা বন্দী আছে সোনার খাঁচায়!

পাখিটা বন্দী আছে সোনার খাঁচায়! দূর বিদেশে বাণিজ্যে গিয়ে এক বণিক সেখানকার এক বনে বিশেষ একটি পাখির গান শুনে মুগ্ধ হলেন এবং পাখিট...

জনপ্রিয়

[blogger]

MKRdezign

Mohammod Sahidul Islam

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget