কবি আল মাহমুদ, বিস্ময়কর প্রতিভা নিয়েও বিজেতা

কবি আল মাহমুদ, বিস্ময়কর প্রতিভা নিয়েও বিজেতা 

১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, রাত তখন ভারতীয় সময়ে সাড়ে এগারোটা। সংবাদ ভেসে এল বাংলাদেশের কবি আল মাহমুদ প্রয়াত। বাংলা কবিতাচর্চা যারা করেন তারা যতই উন্নাসিক হোন না কেন কবি আল মাহমুদকে প্রকৃত কবি হিসেবে স্বীকার করেন, কেউ প্রকাশ্যে কেউ জনান্তিকে। বাংলাদেশ সেদিন স্পষ্ট দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। একদল কবি আল মাহমুদকে সামান্য শ্রদ্ধা জানানোর বিপক্ষে। অন্যদল কবি আল মাহমুদকে মরণোত্তর সামান্য সম্মান জানাতে উদ্যোগী। কিন্তু সেদিন জিতে গেল কবি আল মাহমুদকে শেষ সম্মান জানানোর বিপক্ষীয়রা। কবির মরদেহ নেওয়া গেল না শহিদ মিনারে। তার দাফন হল না ঢাকার মিরপুরের শহিদ বুদ্ধিজীবীদের কবরস্থানে। ‘বাংলা অ্যাকাডেমি’তে কিছুক্ষণের জন্যে নেওয়া হলেও তার সমাধি হল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌরাইল গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে। আমার মনে পড়ে গেল কবির লেখা একটি অমোঘ লাইন – 

পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা
দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা… 

তাহলে কি সেদিন কবি পরাজিত হয়েছিলেন? নাহ, কবিরা কখনও পরাজিত হয় না।

কে আল মাহমুদ ? বাংলা ভাষার কত বড় কবি সে? ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই প্রবল বর্ষণের এক রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামের এক ব্যবসায়ী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন কবি। মাত্র ১৮ বছর বয়স ১৯৫৪ সালে সংবাদপত্রে লেখালেখির সূত্র ধরে কবি ঢাকা আসেন। তখন থেকেই তাঁর কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’ পত্রিকা এবং কলকাতার ‘নতুন সাহিত্য’, ‘চতুষ্কোণ’; বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত বিখ্যাত ‘কবিতা’ পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে ঢাকা-কলকাতার পাঠকদের কাছে তাঁর নাম সুপরিচিত হয়ে ওঠে; তাকে নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়। দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় প্রুফ রিডার হিসেবে সাংবাদিকতা জগতে পদচারণা শুরু করেন। ১৯৫৫ সালে কবি আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী ‘কাফেলা’ পত্রিকার চাকরি ছেড়ে দিলে তিনি সেখানে সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘লোক-লোকান্তর’ সর্বপ্রথম তাকে স্বনামধন্য কবিদের সারিতে জায়গা করে দেয়। এরপর ‘কালের কলস’, ‘সোনালি কাবিন’, ‘মায়াবী পর্দা দুলে উঠো’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থগুলো তাকে প্রথম সারির কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ঝড় তোলে ‘সোনালী কাবিন’।

‘সোনালি কাবিন’ একটি বহুমাত্রিক কবিতা। আল মাহমুদের কাব্যখ্যাতির মূল স্তম্ভ এই কবিতাটিতে বিবিধ বৈপরীত্যের সহাবস্থান ঘটেছে। কাবিনবিহীন হাত দুটি অর্পণ করেও কবি বয়ন করেন প্রতিশ্রুতির তালিকা, গ্রাম্য কিশোরীর লজ্জাবিধূর এবং অসংস্কৃতমনের কাছে হাজির করেন ইতিহাস-লোকবিশ্বাস-নৃতত্ত্ব-রাজনীতির তথ্যভারাক্রান্ত এক জটিল বাকবিভূতি। কৌমের যৌথসংগ্রামের স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দিয়ে শেষপর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকেন প্রেমাকুল এক ব্যক্তিসত্তা। তৎসম তদভব শব্দের জটিল বুননের মধ্যে অবলীলায় গেঁথে দেন মুসলমানি ‘জবান’-এর নানাবিধ শব্দের ফুল। কিন্তু এতসব বৈপরীত্য সত্ত্বেও ‘সোনালি কাবিন’ একটি আশ্চর্য কবিতা। কবি আল মাহমুদ স্মৃতিতে থেকে যাবেন মূলত এই একটি কবিতার জন্য । নিপাট সরল এক আত্মিক-দৈহিক বিবাহের পয়গাম নিয়ে দুয়ারে দাঁড়িয়ে কবি উচ্চারণ করলেন কামিনীর প্রতি 

“সোনার দিনার নেই, দেন মোহর চেয়ো না হরিনী
 যদি নাও, দিতে পারি কাবিনহীন হাত দুটি
  আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি
আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;  
ছলনা জানিনা বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি।”

প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লোক-লোকান্তর’(১৯৬৩) গ্রন্থে নিচু কন্ঠস্বরে তিনি তাঁর অনুভবের কথা, তাঁর পারিপাআরশ্বিক কম্পমান অগ্রসরমান জীবনের কথা বলে গেছেন । তিনি বললেন, 

‘আমার চেতনা যেন শাদা এক সত্যিকারের পাখি
বসে আছে সবুজ অরণ্যে এক চন্দনের ডালে;...... 
লোক থেকে লোকান্তরে আমি যেন স্তব্ধ হয়ে শুনি
 আহত কবির গান।’ 

পরবর্তী গ্রন্থ ‘কালের কলসে’(১৯৬৬) এ চেতনা অনেক পরিণত; লোকজ উপাদানের ব্যবহারে আরো সিদ্ধহস্ত। 

‘....এই দলকলসের ভীড়ে ঝোপে আমার কাফন পরে আমি কতকাল
 কাত হয়ে শুয়ে থেকে দেখে যাবো সোনার কলস আর বৃষের বিবাদ?’ 

জসীমউদ্দীন যেখানে লোকসাহিত্যের উপাদানের উপর তাঁর কুটির তৈরী করেছেন, আল মাহমুদ সেখানে এই গ্রন্থে আধুনিক এক প্রাসাদের কারুকার্যে লৌকিক উপাদান ব্যবহার করলেন।

বছর তিনেক পরের ‘সোনালী কাবিনে’ আল মাহমুদ অলখের দেখা পেলেন; অধরাকে ধরে ফেললেন। চৌদ্দটি সনেটের সমন্বয়ে এ কবিতাগুচ্ছ বাঙলা সাহিত্যের এক মাইলফলক। এখানে আছে প্রতীকী ভাষন; নিখুঁত বর্ণনা; আবেগ স্পন্দিত স্তবক; বিচ্ছিন্ন সুন্দর লাইন।  আল মাহমুদ যখন এরকম করে বলে ওঠেন – 

আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন,
পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণীর উচ্ছেদ
 এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ
যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ। 

তখন কোনো দুর্মুখেরও এ সাহস থাকে না যে বলে, এ কাব্যের আবেদন কেবল দেশের মাটিতেই সীমাবদ্ধ। গ্রামের মাটি থেকে বিচিত্র আকুল আগ্রহকে কবি উন্মোচন করেছেন, নদীর চরের প্রতি কৃষানীর অধিকার প্রতিষ্ঠার রূপকল্পে প্রমাণিত হয়েছে নারীর প্রতি পুরুষের আকাঙখার ক্ষুধার্ত নদীর উপমায় নর-নারীর কামনার চিত্র। এইতো আমাদের আল মাহমুদ এবং তার গ্রামীন প্রান্তরের উপঢৌকন যেখানে যৌনতার আন্তরিক অভিব্যক্তি ঘটেছে : 

বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল
পৌরুষ আবৃত করে জলপাইয়ের পাতাও থাকবেনা
তুমি যদি খাও আমাকেও দিও সেই ফল
জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হবো চিরচেনা ।

সোনালি কাবিন’ সাম্প্রতিক কবিতা-ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা দ্রোহী কবিতা, সর্বাপেক্ষা যৌন কবিতাও সম্ভবত, কেননা আল মাহমুদ এমন একজন শক্তিশালী অর্জুন, যিনি কামনা-যৌনতার ধনুতেও অনায়াসে বিপ্লবের ছিলা পরাতে পারতেন। অথবা বিপ্লবের বল্লমের ফলায় খচিত করতে পারেন রতির কারুকাজ।  

মুক্তিযুদ্ধের পরে তিনি ফিরে যান ঢাকায়। ১৯৭৩ সালে তিনি কারাবরণ করেন৷ ১৯৭৫ এ তিনি মুক্তি পান৷ এই ‘৭৩ থেকে ’৭৫ সালটাই কবির জীবনের এক সুবিশাল টার্নিং পয়েন্ট। আজীবনের সমাজতন্ত্রী, বাম রাজনীতির প্রতি সহনুভূতিশীল আল মাহমুদ ঝুঁকে পড়েন ধর্মের দিকে। এ সময় তিনি সিদ্ধান্থীনতায় ভুগছিলেন। ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’(১৯৭৬) তে সেই সিদ্ধান্তহীনতা, দ্বিধা প্রকাশিত হয়েছে বারেবারে। ইতিমধ্যে তাঁর কবিখ্যাতি পৌঁছে গিয়েছে রাষ্ট্রপতির বাসভবন পর্যন্ত৷ কারামুক্তির পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও তাঁকে ডেকে শিল্পকলা একাডেমীর প্রকাশনা বিভাগের সহ-পরিচালক পদে নিয়োগ দেন৷ ১৯৯৩ সালে তিনি ওই বিভাগের পরিচালকরূপে অবসর নেন। 

অদৃষ্টবাদীর রান্নাবান্না’ (১৯৮০) কাব্যগ্রন্থে কবি মানসিক দ্বিধাদ্বন্দ্ব অনেকটাই কাটিয়ে উঠে নিজের বিশ্বাসকে ধর্মের দিকে টেনে নিয়ে এলেন। মহানবী হযরত মোহাম্মাদকে(স) নিয়ে লিখলেন, - 

“গভীর আঁধার কেটে ভেসে ওঠে আলোর গোলক
সমস্ত পৃথিবী যেন গায়ে মাখে জ্যোতির পরাগ
তাঁর পদপ্রান্তে লেগে নড়ে ওঠে কালের গোলক
বিশ্বাসে নরম হয় আমাদের বিশাল ভূভাগ।” (হযরত মোহাম্মদ)

আর ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’(১৯৮৫), ‘আরব্যরজনীর রাজহাঁস’(১৯৮৭) এবং ‘প্রহরান্তরের পাশফেরা’(১৯৮৮)- এই তিনটি গ্রন্থে কবি নিজের নতুন বিশ্বাসগত পরিচয়কে নির্দ্বিধায় মেলে ধরলেন। চিৎকার করে বলে উঠলেন, - ‘

মাঝে মাঝে হৃদয় যুদ্ধের জন্য হাহাকার করে ওঠে
মনে হয় রক্তই সমাধান, বারুদেই অন্তিম তৃপ্তি;
আমি তখন স্বপ্নের ভেতর জেহাদ, জেহাদ বলে জেগে উঠি।”
(বখতিয়ারের ঘোড়া)।

‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ কবিতা সংকলনে কবি আল মাহমুদ এমন একটি ঐতিহাসিক চরিত্রকে তাঁর কাব্যিক বন্দনায় সিক্ত করেছেন যিনি বাস্তবে বইহীন পৃথিবীরই স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি। মাত্র আঠারো অশ্বারোহী ব্যবসায়ীর ভেক ধরে তিনি গৌড় অধিকার করেছিলেন বলে একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। কিন্তু কাহিনীটি আংশিক প্রমাদযুক্ত। মুসলমানদের শৌর্যবীর্যে মোহাবিষ্ট একজন অতীতকাতর মুসলমান হিসেবে আল মাহমুদ সেই বীর আর তার ঘোড়াকে বন্দনা করে পদ রচনা করতেই পারেন। কিন্তু সেই বীরের শৌর্যবীর্যের সাথে একটি ঐতিহাসিক কলঙ্কও যে অনপনেয় হয়ে আছে সেটা আল মাহমুদ ভাল করে জানলেও তাঁর কাছে সেই কলঙ্কের চেয়ে মহিমান্বিত ছিল বখতিয়ার খলজীর ঐতিহাসিক বিজয়- 

আল্লার সেপাই তিনি, দুঃখীদের রাজা। 
যেখানে আজান দিতে ভয় পান মোমেনেরা,
আর মানুষ করে মানুষের পূজা,
সেখানেই আসেন তিনি। 
খিলজীদের শাদা ঘোড়ার সোয়ারি।

ক্রমেই তার মৌলবাদ তার কবিতায় মাথা চাড়া দেয় যখন  তার কন্ঠে যখন উচ্চারিত হয় – 

এই পার্বত্য উপত্যকার 
প্রতিটি পাহাড়চুড়ো এবং পবিত্র স্তম্ভগুলোর শপথ, শপথ 
পবিত্র কাবা তাওয়াফকারী এখানে উপস্থিত প্রতিটি 
নর-নারীর। যদি দলবদ্ধভাবে একবার, শুধু একবার। এমনকি 
নিরস্ত্রভাবেও একবার। যদি 
আমার দেশ প্যালেস্টাইন। 
শত্রু অধিকৃত একটা শহর। আপনাদের 
প্রথম কেবলা। একবার যদি ভাইগণ। 
আল কুদসের দিকে মুখ ফেরান, একবার।.......”(মীনার প্রান্তরে ইয়াসির আরাফাত)।

কবি আল মাহমুদের কবিতায় ১৯৯০-এর দশক থেকে বিশ্বস্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস উৎকীর্ণ হতে থাকে; এজন্য তিনি তথাকথিত প্রগতিশীলদের সমালোচনার মুখোমুখি হন। ১৯৯৩ সালে বের হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘কবি ও কোলাহল’।  ইসলামি আদর্শের প্রতিফলন ঘটতে থাকে তাঁর লেখায়। তিনি লেখেন – 

অথচ ঘুমের মধ্যে কারা যেনো, মানুষ না জ্বীন
আমার কবিতা পড়ে বলে ওঠে আমিন, আমিন।

কিন্তু ধর্মবিশ্বাসের সাথে ধর্মব্যবসায়ীদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় অগণিত মানুষ হত্যাকারী রাজাকারদের গুলিয়ে ফেলেন। তিনি হাত মেলান জামাতীদের সাথে। আলবদর আলশামসের ঘৃণ্য খুনিদের সাথে। আল মাহমুদ বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় গণহত্যার রূপকার গোলাম আজমের পক্ষে যে বাক্য রচনা করেছিলেন তা ক্রোধ সৃষ্টি করে সমগ্র বাঙালিদের পক্ষে: 

"অধ্যাপক গোলাম আযম এর মত প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ এই উপমহাদেশে ক্রমাগত বিরল হয়ে এসেছে। তাঁর জীবনের খুটিনাটি বিষয় এবং রাজনৈতিক বিনিময়ের কৌতুহল উদ্দিপক ঘটনা অনেকেরই অজানা। তিনি সাহসী মানুষ এবং সুদৃঢ় মনবলের অধিকারী। তার বয়স আশির কোঠায়। কিন্তু তিনি অটুট স্বাস্হ্য এবং রাজনৈতিক ধীশক্তি সম্পন্ন। গত ৮০-র দশকে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে কেয়ারটেকার সরকারের ফর্মুলা দিয়ে জাতিকে এক ঘনায়মান রাজনৈতিক দুর্যোগ থেকে উদ্ধার করেছেন। এতে বুঝা য়ায়, তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এই ৮০ বছর বয়সেও সতেজ এবং উদ্ভাবনাময়।" 

আল মাহমুদ একালে কমিউনিস্ট ছিলেন। তারপর হলেন মুসলিম জাতীয়তাবাদী। তারো পরে হলেন জিহাদী মুসলমান। তিনি গোলাম আযম, সাঈদীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বাংলা ভাষার প্রধান কবিদের একজন হয়ে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি ছিলেন দুর্বল। লাইনে দাঁড় করিয়ে যারা মানুষ মেরেছিলো, নারীদের গণিমতের মাল করে পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে তুলে দিয়েছিলো যারা- সেই লোকদের অপরাধগুলো তিনি অপরাধ মনে করতেন না। তার বখতিয়ারের ঘোড়া কবিতায় এই লাইনগুলো দেখলে চিত্র পরিষ্কার হবে , 

‘মা পাখা ঘোরাতে ঘোরাতে হাসেন,
আল্লার সেপাই তিনি, দুঃখীদের রাজা।
যেখানে আজান দিতে ভয় পান মোমেনেরা,
আর মানুষ করে মানুষের পূজা,
সেখানেই আসেন তিনি।‘

এই সময় ঔদ্ধত্যের চরমে উঠলেন কবি আল মাহমুদ। সারা বাংলাদেশ উত্তাল ’৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়ে। বসল গন আদালত। দাবি একটাই। লক্ষ লক্ষ বাঙালির হত্যাকারী পাকিস্তানীদের দোসর রাজাকারদের বিচার চাই। প্রশ্ন করা হল আল মাহমুদকে – ’৭১ এর বুদ্ধিজীবী হত্যার নায়ক গোলাম আজমের বিরুদ্ধে যে গন আদালত বসানো হয়েছে, সে সম্পর্কে আপনার প্রতিক্রিয়া কি? আল মাহমুদ উত্তরে বললেন – 
"আমি মনে করি গন আদালত যারা বসিয়েছে তারা দেশদ্রোহী। যারা গন আদালত বসায় তারা দেশের শত্রু।"  

এর পরে আল মাহমুদকে সাধারণ মানুষ ছুঁড়ে ফেলে দেয় তাদের মননের সীমার বাইরে। উপেক্ষিত আল মাহমুদ পরে দুঃখ করে লিখেছেন – 

“আমার কাঁধে বিরাট সংসার। আমার রোজগার দিয়ে ছেলেমেয়েদের বড় করতে হয়েছে। ভালো কোনো চাকরি আমাকে কেউ দেয়নি। প্রচুর শ্রম দিতে হয়েছে। নানা ধরনের গদ্য লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু করতে পারলাম না। বন্ধুদের, কবিদের দেওয়া মানসিক চাপ উপেক্ষা করে সমাজে জায়গা করে নিতে হয়েছে আমাকে। কেউ কোনো স্পেস আমাকে দিতে চায়নি। অনেক ধাক্কা খেয়েছি, মুক্তিযুদ্ধ করেছি, জেলও খেটেছি। আমাকে বলো, একজন কবি আর কী কী করতে পারে? আমাকে স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়নি। এখন কোনো কিছুতেই আমার আর আফসোস নেই।”

কিন্তু এই উপেক্ষাপ্রাপ্তি তার অনিবার্য ছিল। দেশের আগে কখনো কবিতার উতকর্ষ নয়। যারা আল মাহমুদের গুণগ্রাহী তার ব্যক্তি আল মাহমুদ নয় তার কবিতার অনুরাগী। কলকাতাও তাই। এখানকার বেশিরভাগ কবি ও কবিতাপ্রেমীরা কবি আল মাহমুদের পদস্খলন জানেন না। তাই তারা কাগজে সোচ্চারে বলেন – আল মাহমুদ ‘মৌলবাদী’ এই কুযুক্তি মানি না। আল মাহমুদ যে কলকাতাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেছেন – 

“কলকাতায় গেলে আমাকে পরিচিত ও অপরিচিতজনেরা ঘিরে থাকে। তারা আমাকে পাঠ করে। তোমার জানা উচিত, ওখানকার বড় পত্রিকাগুলো আমার লেখা যেকোনো সময় ছাপাতে আগ্রহী। সেখানে আমার কবিতার অনেক পাঠক আছে। কলকাতায় তো আমাকে কেউ মৌলবাদী বলে না!”

না, কথাটা ঠিক নয়। কলকাতা জানে না যে কবি আল মাহমুদের অর্থের জন্যে শেখ মুজিবের কাছে আত্মসমর্পণ করে শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও চাকরি পাওয়ার গল্প, জিয়ায়ূর রহমানের কাছে মাথা বিকিয়ে সাহিত্য জগতে মুরুব্বি হওয়ার গল্প, স্বৈরাচারী এরশাদের কাব্য সহায়ক হয়ে মাত্র এক টাকার বিনিময়ে বনানীতে জমি পাওয়ার গল্প, ’৭১ এর ঘাতক দালাল গোলাম আজমের জীবনী লেখার সাহায্যকারী হিসেবে জীবনযাপনের গল্প। কলকাতা জানে তার অসাধারণ কিছু কবিতা। তার প্রথম কবিতা থেকেই যেখানে তিনি লেখেন – 

আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখো বুকের গঠন
লুকানো যায়না তবু অনিবার্য যৌবনের ফুল
প্রতীকের মত যেন জেগে থাকে তোমার জঘন ।” (অহোরাত্রঃ লোক লোকান্তর) । 
কবি আল মাহমুদের কবিতা অবশ্যই বেঁচে থাকবে। গৌরবে, শ্রদ্ধায়।  কিন্তু তিনি থাকবেন আক্ষেপে তার লেখা কবিতার মত -  

“মরণের পরে শুধু ফিরে আসে কবরের ঘাস
যতক্ষণ ধরো এই তাম্রবর্ণ অঙ্গের গড়ন
তারপরে কিছু নেই,তারপর হাসে ইতিহাস”। 

ইতিহাস ব্যক্তি আল মাহমুদকে পিছু তাড়া করবেই যেমন করেছিল নাৎসি সমর্থক কবি এজরা পাউন্ডকে। কারণ মানব সভ্যতার আগে কবিতা নয়।

Post a Comment

Featured Post

পাখিটা বন্দী আছে সোনার খাঁচায়!

পাখিটা বন্দী আছে সোনার খাঁচায়! দূর বিদেশে বাণিজ্যে গিয়ে এক বণিক সেখানকার এক বনে বিশেষ একটি পাখির গান শুনে মুগ্ধ হলেন এবং পাখিট...

জনপ্রিয়

[blogger]

MKRdezign

Mohammod Sahidul Islam

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget