মন বাড়িয়ে ছুঁই - পর্ব-১

' - আব্বা,তাড়াতাড়ি আহেন! এক শহুরা পোলা কুত্তার মতো ভাইরে পিডাইতাছে! ভাইয়ে বাচতো না আব্বাজান! জলদি আহেন! '

অস্থির কন্ঠের চিল্লাচিল্লি শুনেই কলিজা শুকিয়ে এলো সবার। সত্যি-সত্যিই বাড়ির বাইরে এক অপরিচিত ছেলে বেধড়ক পিটিয়ে যাচ্ছে সাইদুলকে। সাইদুলের নাক-মুখ দিয়ে চুটিয়ে রক্ত পরছে, সেদিকে একচুল পরিমাণ ধ্যান নেই ছেলেটার! রাগের কারণে ছেলেটার কপালে ঘাম, সেই সাথে হাতের অবস্থাও নাজেহাল। তবুও লম্বা উচ্চতার মানুষটা বেপরোয়া ভঙ্গিতে শার্টের দুই হাতা কনুইয়ে তুলে ধুমছে পেটাচ্ছে সাইদুলকে। তার পাশেই মাটিতে লুটিয়ে হাহাকার করছে আরো তিনটে ছেলে! শরীরের অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোনো মায়াদয়া করেনি ছেলেটা। হান্নান দ্রুত পরিস্থিতি সামলানোর জন্য ছেলেটাকে চিৎকার করে বললো, 

  - কে তুমি? কোথা থেকে এসেছো? কেনো ওদের মারছো? এ্যাই ছেলে? 

 যতটা কঠোর হলে এই ছেলেকে দমানো যায়, সেই ভাবভঙ্গিতে বললেন হান্নান। 
কথাটা কানে যেতেই হাতের বাশঁটা যেনো ক্ষণিকের জন্য থামলো। ছেলেটার নাম মাহতিম আনসারী এবং সে পরিবারসহ গ্রামে ঘুরতে এসেছিলো। পথিমধ্যে বড়বাজারের মোড়ে চারটে বখাটে ছেলে মাহতিমের চাচাতো-ফুপাতো বোনগুলোকে বিশ্রী ইঙ্গিতে কথা বললে মাহতিম একটুও ছাড় দেয়না ওদের! ভয়ে ছেলেগুলো বাইক নিয়ে পালালে মাহতিমও জিপ ছুটিয়ে ভয়ঙ্কর ভাবে ধাওয়া করে! একেবারে বাইকের সবকটাকে মাটিতে ফেলে বাশঁ তুলে অনবরত পিটাতে থাকে। হৈচৈ হট্টগোলে গ্রামের লোকজন জড় হলে দ্রুত একজন দৌড়ে গিয়ে জমিদার মোল্লাকে ডেকে আনে। মোল্লা এসেই দেখেন, ছেলেটার পড়নে সাহেবদের মতো পোশাক, পায়ে চকচকে কালো সুজ। কালো শার্ট, কালো প্যান্ট, কালো বেল্টের বেশভূষায় এক সুদেহী পুরুষ। গায়ের রঙ ধবধবে সাদা না হলেও উজ্জ্বলবর্ণের মানানসই স্কিন টোন তার। রোদের দাপটে কপাল চুয়ে চুয়ে পানি পরছে তার, হাতের চামড়াও ভীষণ লাল হয়ে আছে যেনো। 
এবার ছেলেটা শক্ত দৃষ্টিতে বৃদ্ধের পানে চোখে-চোখ রেখে  তাকালো। একজোড়া চোখের এমন ভয়ংকর তেজ দেখে হান্নান চট করে ছেলেটার হাত থেকে বাশঁ ছিনিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো! তৎক্ষণাৎ আবার পরিচয় জিজ্ঞেস করলে ছেলেটা বিরক্তিতে চুরমার হয়ে বললো, 

  - এই কুকুরের বাচ্চাগুলো এমন গ্রামে থাকার সুযোগ পায় কিভাবে? আপনি কি এই গ্রামের মোল্লা না? কিভাবে এমন জ্বলুনি কুকুরদের গ্রামে পুষেন? ওদের বাপ টাকা দেয়? সবকয়টা শালা ---

 হান্নান চকিত দৃষ্টিতে ছেলেগুলোর দিকে তাকাবে ওমনেই পেছন থেকে শো শো করে দুটো মাইক্রো আসার শব্দ হলো। ধুকপুক ধুকপুক করে হৃদযন্ত্র চলতেই বৃদ্ধ তৎক্ষণাৎ তরমুজের মতো চক্ষু করে ফেললো। অবাক-হতবাক-কৌতুহল দৃষ্টিতে দেখলো, একজন প্রৌঢ়া ও ছোট ছেলে বাদে চারটে ছেলে, তিনটে মেয়ে সমস্বরে দৌড় লাগিয়ে চেঁচিয়ে আসছে, ' মাহতিম ভাই! আর ইউ ওকে? ' । মাহতিম সেদিকে লক্ষ রেখে রক্তাক্ত হাতের মুঠো থেকে বৃদ্ধাঙ্গুল তুলে ইশারায় ' সুস্থ আছে ' বোঝালো। ততক্ষণে দৌড়ে ভিড় হটিয়ে একেবারে মাহতিমের পাশে এসে দাড়ালো ভাইবোন ও বন্ধুগুলো। বোনগুলো তাড়াতাড়ি মাহতিমের হাত টেনে পানি ঢেলে রুমাল, টিস্যু চেপে ধরলো,সেই সাথে হাতের ঘড়ি খুলে নিলো। অস্থির হয়ে ভাই ও বন্ধুগুলো বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো, ব্রো তুমি ঠিক আছো? কোনো চোট লাগেনিতো? হাতে খুব ব্যথা করছে? স্ক্রাউন্ডেলকে একচোট দিবো নাকি? মাহতিম ইশারায় ওদের উত্তেজিত অবস্থাকে থামিয়ে দিলো। ঠান্ডা ও শান্ত হতে বললে এদিকে হান্নান তখন কপালে ভাঁজ ফেলে প্রৌঢ়ার দিকে চেয়ে ছিলেন, হঠাৎ খুশীর স্বহাস্যে চেঁচিয়ে বললেন, 

  - মারজা, মা তুমি! কি নসিব গো খোদা! এ্যাই সরে দাড়া। তাড়াতাড়ি সরে দাড়া। আমার মারজা মা এসেছে। মাগো, আসো আসো, এদিকে আসো। 
  
প্রৌঢ়ার গায়ে কাতানের সফেদ শাড়ি, মাথায় ঘোমটা, পায়ে নরম কালো জুতা এবং ঠোঁটে মিষ্টি হাসির ছোঁয়া। ঠিক ডানপাশেই মায়ের সাথে আসছে বারো বছর বয়সী মাহদী। মায়ের দেখাদেখি বৃদ্ধর পা ছুঁয়ে সালাম করে ফেলো। তখন মারজা প্রসন্ন কন্ঠে বললেন, 

  - আপনাকে দেখতে এলাম বাবামশাই। আপনার ভিটেবাড়িতে নির্মল হাওয়া খেতে এলাম। কিন্তু আসার সময় যা হলো,

কথা আটকে গেলে বৃদ্ধ আড়ষ্ট হয়ে পুরো ঘটনা জানতে চাইলে মারজা সব খুলে বলেন। সব ঘটনা শুনে প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়ে সাথেসাথে পন্ঞ্চায়েত ডেকে ওদের বিচার করতে নির্দেশ দিলেন। কুটুম নিয়ে বিশাল বাড়িতে উপস্থিত হতেই আপ্যয়নের ধুম পরে গেলো সবার। হান্নান মোল্লার বয়স একষট্টি। আঠারো শতাংশ জমির উপর ভিটেবাড়ি স্থাপন করেছেন তিনি। গ্রামে মোল্লারূপেই বেশ খ্যাতি উনার, তবে একমাত্র জমিদার হিসেবে এখনো নাম-জশ-সুখ্যাতি রয়েছে তাঁর। তিনটা ছেলে আছে, সেই সঙ্গে তিন ছেলের বউ। প্রথম ছেলেটা গত হয়েছে সাতবছর হলো, দ্বিতীয় ছেলেটা গ্রামের হেডমাস্টার, তৃতীয় ছেলেটা কাতার প্রবাসী।  মোল্লা বাড়িতে কয়েক যুগ পর যেনো আগমন  হলো কুটুমের। হান্নান সাহেবের বন্ধুকন্যা কতযুগ পর এসেছে। পথিমধ্যে এমন দূর্ঘটনার কথা শুনে ব্যথিত হলেন খুব। কিন্তু খাতিরের জন্য লেগে পরলেন সবাই।

প্রচণ্ডরূপে মেজাজ খারাপ হয়ে আছে মাহতিমের। এখানে আসাটাই ওর ভুল হয়েছে। মা কসম না দিলে কখনোই আসতো না এখানে। মাহতিমের ফুপাতো বোন নীতি ও প্রীতি পায়ের উপর পা তুলে লেবুর শরবত খাচ্ছে। একটু পরপর মাহদী এসে বাড়ির রির্পোট দিয়ে যাচ্ছে। চাচাতো ভাই সামিক, সাবির শার্টের কলার টেনে সোফায় বসে আছে। বন্ধু সিয়াম, সৌভিক, তৌফ গরমের জ্বালায় অতিষ্ঠ বোধ করছে। এদিকে সবচেয়ে ছোট চাচাতো বোন ফারিন ঘুরঘুর করে পুরো বাড়ি দেখছে। 

বাড়ির দোতলা থেকে চারজোড়া চোখ অতিথি দেখার জন্য অপেক্ষা করছে। কখন দাদাভাই তাদের খাবার ঘরে ডাকবেন সেটার জন্য প্রহর গুণছে। তিনজনের পড়নে বিভিন্ন রঙের শাড়ি থাকলেও কেবল একজনের শাড়িটা সাদামাটা। বোনদের থেকে দূরে দাড়িয়ে আকাশ দেখছে মানবীটা। গ্রামের রেওয়াজ ও বহুদিনের ঐতিহ্য হিসেবে সব মেয়েদের শাড়ি পরার নিয়ম। বাকি তিনটা বোন দোতলার সিড়ি ধরে ছেলেগুলোকে দেখার জন্য ছটফট করছে। একটু আগে জানতে পেরেছে, বাড়িতে অনেকগুলো সুন্দর-সুন্দর ছেলে এসেছে। সবাই দেখতে লা-জাবাব! একেকটা জম্পেশ রূপবান! মেয়েগুলোও সুন্দরী এবং পোশাক-আশাকেও ফিটফাট! এগুলো শোনার পর থেকেই প্রচণ্ড উৎকন্ঠায় অস্থির হয়ে গেছে সুরাইয়া, সাবা, শাহনাজ । হালকা গোলাপীর সুতির শাড়িতে ভোঁতা মুখে দাড়িয়ে আছে মেহনূর। হঠাৎ সুরাইয়া যেনো  শাহনাজের উদ্দেশ্যে চিল্লিয়ে উঠলো, 

  - আপু, আপু, এই দেখো ওরা আসছে।ওদের খাবার ঘরে দাদাভাই ডেকেছে! তাড়াতাড়ি দেখো আপু!তাড়াতাড়ি!

সুরাইয়া থামতে দেরি ওমনেই একে-একে সবগুলো ছেলে ওদের দৃষ্টিসীমানার বাইরে চলে গেলো। প্রচণ্ড স্পিডে ধুকপুক করতে থাকা বুকটা আরো বেতাল ভঙ্গিতে ছুটতে লাগলো। সত্যিই মোল্লা বাড়িতে পুরুষের আগমন অদ্ভুত অনুভূতির সন্ঞ্চার করছিলো! কিন্তু কে জানতো তিনজোড়া চোখের হাসি-হাসি দৃষ্টি আকস্মিকভাবে আটকে যাবে? কে জানতো বুকের হুলস্থুল কাঁপুনিটা ধ্বক-ধ্বক করে চাবুকের মতো পিটাবে? কে জানতো সিনেমার সেই ডায়লগের মতো সত্যি-সত্যিই হার্টবিট মিস হবে?  সিড়ির রেলিং আকড়ে বরফের মতো শক্ত হয়ে গেলো শাহনাজ, মুখের চোয়াল ঝুলিয়ে হা করে  ফেললো সুরাইয়া, বিস্ফোরণ চাহনিতে আশ্চর্য হয়ে শব্দ গুলিয়ে ফেললো সাবা। সকলের হৈচৈ চিল্লাচিল্লি যখন সহসা থমকে গেলো, তখন কৌতুহল মনে পিছু তাকায় মেহনূর। তিন বোনের ওমন মুখভঙ্গি দেখে সাথেসাথে ভ্রুঁ কুন্ঞ্চন করে দোতলা থেকে নিচে দৃষ্টি ফেললো। ওমনেই শরীরের প্রতিটি পশম কাঁটা দিয়ে সূচের মতো বিঁধলো! শুধু দৃষ্টি আটকে রইলো সুদেহী, সুদীর্ঘ, সৌম্যদর্শনের ন্যায় এক সুদর্শন পুরুষের উপর! যার প্রশস্ত বুকটা কালো শার্টের আড়ালে আটঁসাটভাবে ঢেকে আছে। শার্টের দুটো টপ বোতাম খোলার কারনে উন্মুক্ত বুকের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে। লোভনীয় বস্তুর মতো নয়তো অনেকটা কাঙ্গালের মতোই তাকিয়ে আছে তার বিশাল বুকের দিকে। কোমরে কালো বেল্টের সাহায্যে শার্টটা ইন অবস্থায় রয়েছে। কানে ফোন লাগিয়ে অন্য হাতটা পকেটে গুঁজে মানুষটা রাগচটা ভঙ্গিতে চলে যাচ্ছে। মাথার একঝাঁক চুল ট্রিমকাটে রূপ নিলেও সেই চুলগুলো জেলের কারনে অটল হয়ে আছে। স্বল্প মূহুর্ত্তের অল্প দর্শনে দেখার তৃষ্ণা একটুও মিটলো না যেনো। আর সহ্য করতে না পেরে তৎক্ষণাৎ চোখের পাতা বুজে ফেললো। কেউ জানেনা আগামীকাল কি আসতে চলেছে। কেউ কিছুই জানেনা কি হতে যাচ্ছে। কিভাবে মুখোমুখি হবে এই মানুষটার? কেউ কি বেঁকে বসবে শেষমেশ? নাকি অপেক্ষা করছে অন্যকিছুর ক্ষণকাল?

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
#পর্বসংখ্যা_০১.

Post a Comment

Featured Post

পাখিটা বন্দী আছে সোনার খাঁচায়!

পাখিটা বন্দী আছে সোনার খাঁচায়! দূর বিদেশে বাণিজ্যে গিয়ে এক বণিক সেখানকার এক বনে বিশেষ একটি পাখির গান শুনে মুগ্ধ হলেন এবং পাখিট...

জনপ্রিয়

[blogger]

MKRdezign

Mohammod Sahidul Islam

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget