সতিত্বের কালো দাগ

সূচনা পর্ব


বাসর রাতে আমার স্বামী, আমার পেটে লা*থি দিয়ে বিছানা থেকে পেলে দেয়।
এই বাক্যটাই আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সত্য। এই বাক্য দিয়ে আমার নতুন জীবনের সূচনা নয়, বরং চরম এক দুঃস্বপ্নের শুরু হয়েছিল।

তবে গল্পটা এখান থেকে নয়, আরও কিছু মাস পেছনে গেলে বোঝা যাবে আমি কে, কীভাবে আমার জীবন এমন নিষ্ঠুর এক বাঁকে মোড় নিয়েছে।

আমি মিথিলা। বয়স মাত্র বিশ। আমাদের তিন বোনের সংসার। বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। মা নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে আমাদের বড় করেছেন। বড় আপা রিনার বিয়ে হয়েছে পাশের শহরের এক জন শিক্ষককে—মোবারক জামান। আপার শরীরটা তখন খুব একটা ভালো ছিল না। হঠাৎ একদিন মা বললেন,তুই দুইদিনের জন্য আপার বাসায় গিয়ে থাক, আমি তো তোর ছোট বোনটাকে নিয়ে হাসপাতালেই আছি।

আমি রাজি হলাম। ভাবলাম, দুইদিনের তো কথা। আপা অসুস্থ, পাশে থাকা দরকার। আমি তখন একটা টিউশনি করি, ছোট খাটো কিছু ইনকাম, মা বলেন আমি সংসারের দ্বিতীয় ভরসা।

সেদিন সন্ধ্যায় আমি আপার বাসায় পৌঁছালাম। আপা তখন জ্বর নিয়ে ঘুমাচ্ছিলো। জামাইবাবু দরজা খুললেন। স্বাভাবিক ব্যবহার, হাসিমুখ।এতদিন পরে এলে?আপার শরীর ভালো না শুনেই আসলাম।ভালো করছো, তুমি থাকলে ওর খেয়াল রাখবে।

রাতে আপার ওষুধ খাওয়ানোর পর আমি রান্নাঘরে গিয়েছিলাম পানি আনতে। পেছন থেকে একটা ছায়া এসে গলা চেপে ধরলো। আমি ভেবেছিলাম চুরি! কিন্তু পরের মুহূর্তেই বুঝলাম, এ আমার জামাইবাবু!

আমি কাঁপছিলাম, চিৎকার করতে চাইছিলাম—but শরীর জমে গেল।চুপ করো, কিছু বললে কেউ বিশ্বাস করবে না।প্লিজ... ছাড়েন…তুমি অনেক সুন্দর মিথিলা...

কোনো কথা কাজ করলো না। রাতটা একটা দুঃস্বপ্ন হয়ে গেল। সেই রাতে আমার ভেতর থেকে বিশ্বাস, নিরাপত্তা, আর আত্মসম্মান সব কিছু একসাথে মরে গেল।

পরের দিন সকালে আমি চুপচাপ ছিলাম।আপা জিজ্ঞেস করলো,তোর মুখটা এত ফ্যাকাশে কেন?”আমি বলিনি কিছু। মা বলেছিল, মেয়েদের মুখে লজ্জা থাকা ভালো। কিন্তু আজ আমি বুঝলাম, লজ্জা না বললে, অন্যায় আরও বাড়ে।

দিন গেল। এক সপ্তাহ, দু'সপ্তাহ... আমার বুকের মধ্যে একটা চিনচিনে ব্যথা। কারো চোখে চোখ রাখতে পারতাম না। ক্লাসে মন বসতো না। রাতে ঘুম আসতো নাজামাইবাবুর ছায়া সব সময় পেছনে পেছনে।

এক মাস পর, মা আমার চোখে তাকিয়ে বললেন,তুই কিছু লুকাচ্ছিস? শরীর ঠিক আছে?আমি মাথা নিচু করে রইলাম। মা কাছে এসে বললেন,সত্যি কথা বল, না বললে আমি পাগল হয়ে যাব।আমি হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়লাম। সব বললাম। একটা শব্দও বাদ দিলাম না।

মায়ের চোখ বড় বড় হয়ে গেল।কি বললি তুই? জামাইবাবু…? রিনা’র স্বামী?আমি শুধু মাথা নিচু করে থাকলাম।

মা জোরে চিৎকার করলেন না, শুধু নিঃশব্দে চেয়ারে বসে পড়লেন।মনে হলো, যেন তিনি পাথর হয়ে গেলেন। মা শুধু বললেন,এই কথাটা কাউকে বলতে পারবি না। রিনার সংসার ভেঙে যাবে।

সেদিন থেকে আমি বুঝলাম, একজন মেয়ে যখন ভুক্তভোগী হয়, তখনো তাকে সমাজ শুধু বোঝায়, চুপ করো।

মা যেন নিজের ছায়া হারিয়ে ফেললেন। আমি মায়ের মুখে কোনো কথা পাই না। সেই চিরচেনা শক্ত মায়ের বদলে এক অসহায়, ভেঙে পড়া নারী বসে আছেন আমার সামনে।
তিনি বারবার নিজেই নিজের চুলে হাত দিচ্ছেন, মাথা নাড়ছেন, চোখ বন্ধ করে বসে আছেন—নিশ্চুপ।

মা হঠাৎ বলে উঠলেন,না, এ কথা কাউকে বলবি না। রিনার সংসার ভেঙে যাবে। লোকে তোকে দোষ দিবে, রিনাকে দোষ দিবে, আমাকে দোষ দিবে।

আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।তুই চুপ থাক। আমি যা বলি, তাই করবি। এই কথা যেন আর কারো কানে না যায়। তুই জানিস না, মেয়েদের জন্য সমাজটা কেমন কঠিন। বিয়ে দিতেই হবে তোকে।
বিয়ে? কিন্তু মা—
চুপ! আর কিছু শুনতে চাই না!

পরের দিন রিনা আপাকে ডাকা হলো। আমি বুকের মধ্যে ভয় নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম ওর মুখের দিকে। ভাবছিলাম, আপা কি আমার পাশে দাঁড়াবে?

রিনা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,আমি জানি না কার ভুল, কিন্তু এখন এসব বলে কী হবে? আমার স্বামী, আমার সংসার—সব ভেঙে যাবে। আমি তো নিজেই অসুস্থ।

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।এই আমার বড় আপা! যে আমাকে ছোটবেলায় কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াতো, যে বলত আমি নাকি তার চোখের মণি।আজ সে নিজের সংসারের মায়ায় আমাকে দূরে ঠেলে দিলো।

মা দিন দুয়েক পর বললেন,তোর জন্য একটা ছেলে দেখেছি। রাজি না থাকলেও কিছু করার নাই। এই কেলেঙ্কারিটা চাপা দিতে হবে।আমি কিছু বলিনি। মাথা নিচু করে রইলাম।কাঁপা কাঁপা গলায় শুধু বললাম,বাবা বেঁচে থাকলে কি তিনি এমন করতেন মা?

মা কোনো উত্তর দিলেন না।

বিয়ের দিন,,সব কিছু যেন একটা নাটক। সাজগোজ, মেহেদি, হাস্যকর, বউ সাজা।আমার ভিতরটা ফাঁকা। চোখে এক ফোঁটা জল নেই। কারণ চোখে জল আসবে—তা তো কাঁদার জায়গা থাকলে!

ছেলেটা, আমার বর—নাম রিয়াজ। লম্বা, গম্ভীর চেহারা, চোখে সন্দেহের ঝলক।আমাকে দেখে মুখ কুঁচকে উঠেছিল। বুঝতে পেরেছিলাম কিছু বলেছে হয়তো, কিন্তু তবুও বিয়েটা হয়েই গেল।

বাসর রাত,,আমি জানতাম, এ রাত আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রাত হতে যাচ্ছে।রুমে ঢুকে সে দরজা বন্ধ করলো, ঘুরে তাকালো আমার দিকে।ধীরে ধীরে কাছে এল।

আমি কথা বলার সাহস জড়ালাম।একটু কথা বলবো?সে থামলো। ঠাণ্ডা চোখে তাকালো।

আমি শুরু করলাম,আপনি আমাকে চেনেন না, আমিও আপনাকে না। কিন্তু একটা কথা বলা জরুরি—যেটা না বললে আমি প্রতারক হবো।সে কপাল কুঁচকে বলল,কি কথা?

আমি চোখে চোখ রাখলাম।আমি এক মাস আগে ধর্ষ*ণের শিকার হয়েছি। আমার জামাইবাবু কাছে… আমি জানতাম না কী করব… কাউকে বলিনি। তারপর মা আমাকে জোর করে এই বিয়েতে রাজি করিয়েছে।

ঘরটা হঠাৎ যেন জমে গেল।সে ধীরে ধীরে রেগে উঠলো। চোখ লাল হয়ে গেল।তুই কী বললি?

আমি বললাম,আমি চেয়েছি আপনি যেন আগে থেকেই সব জানেন। আমি কাউকে ঠকাতে চাইনি।

সে হঠাৎ এমন এক লাথি মারলো—আমি বিছানা থেকে ছিটকে পড়লাম।তুই দুশ্চরিত্রা! তোকে কি আমার বিয়ে করার দরকার ছিল? এক কাপুরুষের ভোগ্যবস্তু হয়ে এসেছিস আমার ঘরে?

আমি ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলেও, মুখে কোনো শব্দ বেরোল না।
সে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। বাইরে তালা লাগিয়ে দিল।
আমি জানতাম, আমার রাত আজ একা। আর এই রাত থেকে শুরু হবে এক ভয়াবহ অধ্যায়।

ঘুম ভাঙে দরজায় জোরে আঘাতের শব্দে।ওঠ! শুয়ে আছিস কেন এখনো? ভাবিস নিজেকে রানি?রিয়াজ।

আমি দরজার দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ, মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। শরীরে ব্যথা, মনে বিষ, চোখ শুকিয়ে কাঠ। মনে হচ্ছিল, আমি একটা মানুষ না, একটা বাতিল জিনিস—যেটা কারও প্রয়োজন নেই, ভালোবাসা তো দূরের কথা।

দরজা খুলতেই রিয়াজ এক ঝলকে তাকিয়ে বলল,
তোর মতো নষ্ট মেয়েদের জন্য ঘরে জায়গা হয় না। কিন্তু আমি তোকে ঘরে এনেছি, কারণ আমার মা-বাবা কিছু জানে না। আমার মান-ইজ্জতের জন্য তোকে এখন সহ্য করছি।

আমি মাথা নিচু করে রইলাম।তোর মতো মেয়েদের জন্য হাসপাতালে আলাদা বেড থাকা উচিত—যেখানে আগে শুচি করা হয়, তারপর স্বামীকে দেওয়া হয়।

তার কথা শেষ হতে না হতেই সে এক চড় কষাল গালে। আমার কানের পাশে টনটন করতে লাগলো। চোখে ঝাপসা হয়ে এল চারপাশ।

দিনের পর দিন,,রিয়াজ ঘরে ফিরতো গভীর রাতে। চোখ লাল, শরীরে মদের গন্ধ।আমি দরজা খুলে দিলে বলত,
তুই এখনও ঘুমাসনি? খোশামোদ করিস?

তারপর শুরু হতো মারধর। কখনো গলায় চেপে ধরা, কখনো দেয়ালে ঠেলে ফেলা। খিদের যন্ত্রণা, ঘুমহীন রাত, আর অজানা আতঙ্ক—সব মিলিয়ে আমি যেন একটা জীবন্ত লাশ।

একদিন হঠাৎ বমি আসলো। অনেকক্ষণ পরে বুঝলাম—আমি গর্ভবতী।আমি ভয়ে কেঁপে উঠলাম। আমি নিজেই তো জানি না আমার শরীর এখনো কিভাবে টিকে আছে।

বুক কাঁপতে কাঁপতে বললাম,আমি… আমি মা হতে চলেছি।
রিয়াজ থেমে গেল কিছুক্ষণ। তারপর ফুঁ দিয়ে বলল,তুই পাগল? তোকে আমি মা বানাবো? এই নোংরা শরীরে আমার সন্তান?

পরদিন আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। কোনো কথা না বলে আমাকে জোর করে ভিতরে পাঠিয়ে দিল।
চোখে চোখ রেখে বলল,এই বাচ্চা নষ্ট করিয়ে বাড়ি ফিরবি, নয়তো ঘর ছাড়বি।

আমি সেদিন নিজের পেটের ভেতরে থাকা নিষ্পাপ প্রাণের কান্না শুনতে পেলাম।কিন্তু আমি কিছুই করতে পারলাম না।

নিরবতার সংসার,,রিয়াজের মা-বাবা দূরে থাকেন, এখনো জানেন না কিছু। রিয়াজ বাইরে মেয়েদের সঙ্গে রাত কাটিয়ে আসে, আর আমি ঘরে বসে থাকি—নির্যাতনের পরিণতি নিয়ে।

একদিন রিয়াজ বলে বসল,তুই আমার কাছে একটা দেহ ছাড়া কিছু না। তোকে রাখছি শুধু লোক দেখানো বউ হিসেবে। কথা বলবি না, ঘর পরিষ্কার রাখবি, আর যা বলি করবি।আমি কিছু বলিনি।এই নীরবতা এখন আমার সঙ্গী।

ভাঙনের শুরু,তিন মাস হয়ে গেল।শরীরে শক্তি নেই। মনেও না। কেবল একটা ইচ্ছে জাগে—পালিয়ে যেতে। কোথাও চলে যেতে, যেখানে কেউ প্রশ্ন করবে না, কেউ অপমান করবে না।

একদিন রাতে নিজের আয়নায় তাকিয়ে দেখলাম, মুখটা চেনা যায় না। কালো দাগ, ফোলা চোখ, শুকনো ঠোঁট।আমার ভেতরে একটা আগুন জ্বলতে শুরু করলো।
এই আমি না। আমি এমন না। আমি মিথিলা।যে অন্যায়ের সামনে মাথা নত করতো না।


সোর্স: YTS STORY ❤️